মোসাঃ শিল্পী আক্তার, উত্তর বঙ্গের দরিদ্রতম জেলা থেকে ২০১৭ সালে কোনাবাড়ী শিল্প অঞ্চলে আসেন পোশাক শিল্পে কাজ করার জন্য। দেশের বাড়িতে তিনি দেখেছেন, আশেপাশের প্রতিবেশীরা যারা পোশাক শিল্পে কাজ করছেন তারা একটু স্বচ্ছল ভাবেই জীবনযাপন করে আসছেন। প্রতিবেশীদের দেখাদেখি মোসাঃ শিল্পী আক্তার স্বপ্ন পূরনের জন্য গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কোনাবাড়ী শিল্প অঞ্চলে একটি কারখানায় হেলপার পদে চাকরী নেন। উদ্দেশ্য একটাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটু ভালভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থেকে দেশের বাড়িতে আধাপাকা টিনের ঘর তোলা।
এরকম শিল্পী আক্তারের মত দরিদ্র জেলাগুলোর সন্তানেরা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বাংলাদেশের শিল্প অঞ্চল গুলোতে এসে পাড়ি জামায়। শুরু হয় নতুন যুদ্ধ খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার এবং স্বপ্ন পূরনের যুদ্ধ।
গাজীপুর কোনাবাড়ী শিল্প অঞ্চলের ব্যায় দরিদ্র জেলাগুলোর থেকে বেশী হওয়ায় শ্রমিকেরা প্রথমে একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পরে। পোশাক শিল্পের স্বল্প বেতনে -বাসাভাড়া, খাবার, চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়া, টাকা সঞ্চয়ের জন্য পদেপদে মানসিক, শারীরিক এবং পারিবারিক ভাবে লড়াই করে যেতে হয়।
২০১৮ সালে সর্বশেষ পোশাক শিল্পের শ্রমকিদের বেতন বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পায় কর্মরত এলাকায় বসবাসের জন্য সকল উপকরনের ব্যায় এবং দিনদিন এই ব্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের নূন্যতম মাসিক মজুরী ৮০০০ টাকা। হিসেব মতে, এই ৮০০০ টাকা দিয়েই শ্রমিক অনায়াসে মাস কাটিয়ে দেওয়ার কথা কিন্তু, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে একজন শ্রমিকের ব্যায়ের প্রধান ০৩টি খাত হলঃ বাসাভাড়া, খাদ্যক্রয় এবং গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানো। খাদ্য এবং বাসাভাড়া বাবদ একজন শ্রমিক মাসের আয়ের বড় অংশ ব্যায় করে থাকে। শ্রমিকদের মাসিক মোট আয় কম হওয়ায় খাদ্যের মান খারাপ হয়, বসবাসের জায়গাও হয় চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বস্ত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম ব্যায় করে থাকে শ্রমিকেরা। আয় কম হবার কারনে, বিরুপ প্রভাব পরে সার্বিক জীবন মানের উপর।
যারকারনে, শ্রমিকেরা সংসার এবং জীবনযাপনের সার্বিক ব্যায় মেটানোর জন্য হাজিরা বোনাস এবং ওভারটাইম হিসাবকে আয়ের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন।
সংসারের চাহিদার তুলনায় হাজিরা বোনাসের টাকা সামান্য হলেও সেই সামান্য টাকার জন্য শ্রমিকেরা অনেক ভোগান্তির মুখমুখি হয়। জরুরী প্রয়োজনে ০১দিন কাজ কামাই, খারাপ আবহাওয়ায় কারণে/ শারীরিক সমস্যার কারণে/ অন্যান্য কারণে কাজে পৌছাতে দেরী হলেও এই হাজিরা বোনাসের টাকা থেকে বঞ্ছিত করা হয়। আসলে হাজিরা বোনাস হচ্ছে একটি নির্যাতনমূলক ব্যাবস্থা কারন, এই সামান্য টাকার জন্য শ্রমিকেরা ভয়ংকর মানসিক চাপে থাকেন।
এরপর আছে- ওভারটাইম বাবদ প্রাপ্ত টাকার কথা। একজন শ্রমিক মাসে গড়ে ৬০ ঘন্টার উপর ওভারটাইম করে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী ০৮ ঘন্টা কর্মঘন্টার পর যতটুকু সময় একজন শ্রমিক কাজ করবেন ততটুকু সময় ওভারটাইম হিসেবে গন্য হবে। কিন্তু শ্রম আইনে একজন শ্রমিক সপ্তাহে কতঘন্টা ওভারটাইম করতে পারবে তা বাধ্যবাধকতা থাকায় কারখানা কর্তৃপক্ষ ওভারটাইমের হিসাব ঠিকমত করে না / আলাদা খাতায় হিসাব লিখে রাখে/ গোপন করে রাখে / সময়মত প্রডাকশন দিতে না পারার অজুহাতে ২০-৩০ মিনিট সময় ওভারটাইম গুলোকে ফাউ খাটিয়ে নেওয়ার হিসাবে যুক্ত করে থাকে।
শ্রম আইনে দেওয়া আছে- একজন শ্রমিক মাসে ওভারটাইমসহ ২২৪ ঘন্টার বেশী কাজ করতে পারবে না। কিন্তু সত্যিকার হিসেবে করলে দেখা যায়, একজন শ্রমিক মাসে ২৫২ ঘন্টার বেশী কাজ করে থাকে।
আমরা জানি, একজন মানুষের দৈনিক ০৮ ঘন্টার বেশী কায়িকশ্রমে যুক্ত থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। যিনি ০৮ ঘন্টা কাজ করেন তার জন্য ০৮ ঘন্টা ঘুম এবং ০৮ ঘন্টা বিশ্রাম ও বিনোদনের প্রয়োজন। কিন্তু শ্রমিকদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় শ্রমিকেরা গড়ে ০৬ ঘন্টা ঘুমান এবং বিশ্রাম নিয়ে থাকে মাত্র ০১ ঘন্টা।
প্রচন্ড পরিশ্রমের পরেও একজন শ্রমিক ঘুমানো/ বিশ্রাম নেওয়ার সময় পায় না, নেই যথেষ্ট বিনোদনের ব্যাবস্থাও। যারফলে, শ্রমিকেরা অজান্তেই মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
তারপরেও শ্রমিকেরা অত্যাধিক কাজের চাপ/ তীব্র মানসিক বা শারীরিক যন্ত্রনা নিয়ে একজন শ্রমিক মাসে নির্ধারিত কর্মঘন্টা/ সীমার চাইতে বেশী ওভারটাইম করে যাচ্ছে শুধু মাত্র একটু ভালোভাবে জীবনযাপনের জন্য।
শ্রমিক তার মাসের আয় ও ব্যায়ের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য খাবার খরচ একেবারে কমিয়ে দিয়ে থাকে। শ্রমিক খাবারের তালিকায় যেসব খাবার রাখেন- ব্রয়লার মুরগীর মাংস, পাঙ্গাস মাছ, ডিম, ডাল, আলুভর্তা এবং শাকসবজি।
পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞানীদের মতে একজন শ্রমিকের দৈনিক ০৮ ঘন্টা কাজ করার জন্য প্রতিদিন ২৮০০ কিলোক্যালরি শক্তি উৎপাদন করতে পারে এমন পরিমান খাবার খেতে হবে। কিন্তু চলতি বাজারে ২৮০০ কিলোক্যালরি উৎপাদিত খাবার খেতে ব্যায় করতে হবে ৩৫০০ টাকার উপরে। যা কিনা শ্রমিকদের আয়ের উপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে, শ্রমিকেরা বাধ্য হয়েই নিম্ন মানের খাবার খাচ্ছেন।
এরফলে শ্রমিকের শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে বড় (পাইলস, জন্ডিস, কিডনি জনিত সমস্যা, জরায়ু জনিত সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি) এবং ছোট (ঠাণ্ডা, জ্বর, কাশি, মাথা ব্যাথা ইত্যাদি ইত্যাদি) রোগে ধীরে ধীরে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকেরা যেসব বড় এবং ছোট রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে সেগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এসব রোগে আক্রান্ত হবার অন্যতম কারন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করা এবং নিম্ন মানের খাবার খাওয়া।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে- ছোট খাটো রোগের জন্য সকল শ্রমিকই স্থানীয় ঔষধের দোকানে গিয়ে বিক্রেতার পরামর্শ মতো ঔষধ সেবন করে থাকে।
বড় রোগব্যাধির ক্ষেত্রেও অধিকাংশ শ্রমিক নিকটস্থ ঔষধের দোকানে গিয়েই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে থাকেন। এটা তারা করেন প্রধানত টাকা এবং সময় বাঁচানোর জন্য। বড় ধরনের রোগের ক্ষেত্রে অধিকাংশ শ্রমিক বেসরকারি ক্লিনিকে সেবা গ্রহনের জন্য যান। এসব ক্লিনিকের ব্যায় বেশি হলেও শ্রমিক কর্মরত এলাকার কাছাকাছি কম খরচের সরকারি হাঁসপাতাল না থাকায় তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
অধিকাংশ শ্রমিকেরা চায় তাদের সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষিত হবে। শ্রমিকেরা প্রথমে তাদের সন্তানদেরকে কর্মরত এলাকার সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করাতে মনস্থির করে থাকেন, কিন্তু, সরকারি বিদ্যালয়ে সময় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আসন না পেয়ে তারা বেসরকারি কিন্ডারগার্ডেনে সন্তানদেরকে ভর্তি করান। তবে, কিন্ডারগার্ডেনের ব্যায় মিটানো এবং সন্তানদের দেখভাল করতে না পেরে তারা স্থানীয় মাদ্রাসায় সন্তানদের ভর্তি করিয়ে থাকেন। মাদ্রাসাতে কমখরচে সন্তানদের পড়ালেখা এবং প্রয়োজনীয় থাকার ব্যাবস্থা থাকায় মাদ্রাসাগুলো ডে-কেয়ারের বিকল্প হিসেবে কাজ করে।
সর্বপরি শ্রমিকেরা সামান্য আয় দিয়ে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যায় মিটাতে না পেরে বাধ্য হয়ে খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম ব্যায় করে থাকে। বাড়তি আয়ের জন্য ওভারটাইম ও হাজিরা বোনাসের মতো নির্যাতন ব্যাবস্থাকে সহজেই মেনে নিচ্ছেন।
উপরোক্ত সমস্যাগুলি বাংলাদেশের প্রত্যেক শিল্প অঞ্চলের কর্মরত শ্রমিকের সমস্যা। তাই শ্রমিকের এসব সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী শ্রমিকদের বাঁচার মত মজুরী নির্ধারনের পাশাপাশি শ্রমিকদের নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে।
নওশাদ রায়হান
বিসিডব্লিউএস- কোনাবাড়ী।
এখানে পোশাক শ্রমিকদের জীবনের সার্বিক একটা চিত্র ফুটে উঠেছে। পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের দাবি জানাই
শ্রমিকদের বাচার মজুরি দরকার। সকল কিছু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় সকল পণ্য-সামগ্রীর মূল্য যে পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাতে করে শ্রমিকদের এই মজুরি যথেষ্ট নয়। তাই শ্রমিকদের বাচার মজুরি খুব দরকার।