”শ্রমিক বান্ধব ব্লগ”

Bangladesh Center for Workers’ Solidarity

ঘামে শুরু, কাদায় শেষ। অথচ জীবন থামে না

আখি একজন গার্মেন্টস শ্রমিক। নারায়নগঞ্জ শহরের এক ঘিঞ্জি বস্তিতে ছোট্ট একটা ঘরে থাকে সে—স্বামী, ছেলে-মেয়ে আর এক টুকরো স্বপ্ন নিয়ে।

ঘরটা টিনের ছাউনি দেওয়া। এই রোদের দিনে মনে হয় যেন আগুন ঝরে মাথার ওপর! কাঁথা-বালিশ গরমে হাঁসফাঁস করে, ঘুম হয় না রাতেও।  

ভোরে ঘুম থেকে ওঠে।  এই গরমে ঘরের কাজ সেরে আখি রওনা হয় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির দিকে। পলিথিন-আবর্জনায় ভর্তি রাস্তা পেরিয়ে হাঁটে সে। বৃষ্টি হলে রাস্তা ডুবে যায় হাঁটু পানি, আর এখনো শুকায়নি আগের দিনের পানি। জুতা খুলে হাতে নিয়ে হাঁটতে হয়, ড্রেনের গন্ধে নাকে রুমাল চেপে ধরে।   

ফ্যাক্টরিতে ঢুকেই নতুন যুদ্ধ। সেলাই মেশিনের আওয়াজ, গরম বাতাস, আর ঘামজল মিশে এক দমবন্ধ পরিবেশ। ফ্যান ঘোরে ঠিকই, কিন্তু মনে হয় যেন গরম বাতাস ছুড়ে দেয়।

আখি বলে, মনে হয়, গায়ে আগুন লেগে গেছে! মাথা ধরে থাকে। কেউ পানি দিতে বলে না, নিজেই টানতে হয় কষ্ট করে। এই গরমে শুধু আখিই নয়, তার সহকর্মীরাও হাঁপিয়ে উঠেছে।

“গত পরশু সেলিনা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল ফ্লোরে। তার আগের দিন নাসিমা।”

এমন দৃশ্য এখন প্রায় রোজকার। ঠাণ্ডা পানি বা বিশ্রামের সুযোগ নেই। ওষুধ বা চিকিৎসার ব্যবস্থা তেমন কিছুই থাকে না—একটু পানি ছিটিয়ে দিলে ওটাই নাকি ‘চেষ্টা’!

খাওয়া শেষে একটু চোখ বন্ধ করে বসে থাকার সময়টুকুও নেই। স্যাম্পল মাস্টার আবার ডাক দেয়, “আখি শার্টগুলো কাল শেষ করতে হবে!”

বাসায় আরামে ফেরা যেন যুদ্ধ:

ফ্যাক্টরি শেষে বাসায় ফিরতে গেলে জলাবদ্ধ রাস্তায় হাঁটতে হয়। বিশেষ করে বৃষ্টি হলে ঘরের সামনেই পানি জমে থাকে দিন দুই-তিন। রান্নাঘরেও পানি উঠে যায়, গ্যাস আসে না, চুলা জ্বলে না। তখন রান্না করাও কঠিন হয়ে পড়ে। বাচ্চারা কাদামাটি আর পানি পেরিয়ে ঘরে ঢোকে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মশার উপদ্রব বাড়ে, এবং পায়খানা-নালার গন্ধে টেকা যায় না।

আখির স্বপ্ন বড় নয়। শুধু চায়,

– ফ্যাক্টরিতে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া, বিশুদ্ধ পানি।

– বাসায় এসে যেন কাদায় ভিজে না ফিরতে হয়।

– ছেলে-মেয়েরা সুস্থ পরিবেশে বড় হোক।

কেউ তার কথা শোনে না। অথচ প্রতিদিন সে এই গরমে, কাদায়, ক্লান্তিতে টিকে থাকে—জীবনের প্রয়োজনে, বাঁচার আশায়।

Updated: June 17, 2025 — 5:14 pm

শিশুর বয়স নয়,মায়ের প্রয়োজনটাই হোক ডে-কেয়ারের প্রধান উদ্দেশ্য…..

আমার সহকর্মীর গল্প

আমি রুবেলী ঢাকার একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। প্রতিদিন সকালে সাত মাসের ছোট্ট ছেলেটাকে বড় মেয়ের কাছে রেখে কাজে ছুটি। বুকের ভেতর কান্না চেপে রেখে মেশিনের শব্দে নিজেকে ডুবিয়ে দিই। আমি একা নই—আমার মতো হাজার হাজার মা প্রতিদিন একই লড়াই করে যাচ্ছেন।

আমরা যারা শ্রমিক, আমাদের জীবন সহজ নয়। কিন্তু আমাদেরও কিছু অধিকার আছে, যা সরকার আইন করে দিয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮)-এর ৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও কারখানায় ৪০ জন বা তার বেশি নারী শ্রমিক থাকেন, তবে সেখানে একটি ডে-কেয়ার বা শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র থাকতে হবে। যেখানে মায়েরা কাজ করার সময় তাঁদের শিশুদের নিরাপদে রেখে যেতে পারবেন।

তবে বাস্তবতা অন্যরকম। অধিকাংশ কারখানাই এই নিয়ম মানে না। কেউ কেউ ডে-কেয়ার রাখে ঠিকই, কিন্তু শর্ত দেয়—শুধু ১ বছরের বেশি বয়সী বাচ্চা রাখবে! প্রশ্ন হলো, তাহলে একজন মা কি বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখবেন? নাকি বুকের ধুকপুকুনি নিয়েই সন্তানকে বড় ভাই-বোন বা প্রতিবেশীর হাতে রেখে ডিউটি করবেন?

একজন শ্রমজীবী মা হিসেবে আমি বুঝি, শিশু আর কাজের ভার একসাথে বহন করা কতটা কঠিন। আমি চাই, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র আমাদের বোঝার চেষ্টা করুক। আমরা সাহায্য চাই না, শুধু ন্যায্য অধিকার চাই—আমাদের সন্তানদের নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা চাই।

শ্রমিক মায়েদের জন্য ডে-কেয়ার শুধু বিলাসিতা নয়, এটি প্রয়োজন। ৭ মাসের শিশুও মা চায়। আর মা চায়, তার শিশুটি কাজের সময়টুকুতে নিরাপদ ও যত্নে থাকুক।

Updated: June 2, 2025 — 3:19 pm

সাইলেন্ট ডিভোর্স: বাংলাদেশি নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিঃশব্দ যুদ্ধ

গার্মেন্টস কারখানার নারী শ্রমিকদের বড় একটি অংশ গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন জীবিকার সন্ধানে। তাদের জীবনের সাধারণ দৃশ্য হলো—সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ, এরপর ব্যস্ত নগরে ছোট একটি ঘরে ফেরা। অনেকেই স্বামী-সন্তান ছাড়াই শহরে থাকেন। কিছুক্ষেত্রে স্বামী গ্রামে থাকে, বা সম্পর্ক এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তারা আর একে অপরের জীবনে নেই—তবে ‘আইনিভাবেতারা এখনও স্বামীস্ত্রী।

কারণগুলো কী?

  • যখন আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে ওঠেন, তখন অনেকেই আর সহিংস /অবহেলাপূর্ণ সম্পর্কে থাকতে চান না, তারা সম্পর্ক থেকে মানসিকভাবে বেরিয়ে আসেন।
  • বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বামীরা নারীর আয়কে মেনে নিতে পারেন না অথবা কেউ কেউ নারীর অর্থের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে তাদের প্রতি দায়িত্বহীন আচরণ করতে থাকেন। এতে নারী নিজেই সিদ্ধান্ত নেন সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার।
  • অনেক নারী শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিবাহিত অবস্থায় থেকেও স্বামীকে এড়িয়ে চলেন, যাতে সন্তানের পরিচয়ে কোনো সমস্যা না হয়।
  • বিবাহবিচ্ছেদ মানে সমাজে এক ধরনের “কলঙ্ক” হিসেবে দেখা হয়। পাশাপাশি আইনি প্রক্রিয়াও ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। ফলে নারী অনেক সময় ‘চুপিচুপি’ আলাদা থাকার পথ বেছে নেন।

এর প্রভাব চ্যালেঞ্জ

  • এমন সম্পর্ক নারীকে মানসিকভাবে একা করে দেয়। কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া একা সন্তান পালন, কাজ, সংসার চালানো খুব কঠিন।
  • স্বামীর অনুপস্থিতিতে বা সম্পর্কহীনতায় নারীকে অনেক সময় সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।
  • ভবিষ্যতে কোনো আইনগত সুবিধা নিতে গেলে বিবাহিত অবস্থা অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি করে—যেমন জমিজমা, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার ইত্যাদি।

সমাধানের পথ

  • সমাজে ‘বিচ্ছেদ’ শব্দটি নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি। প্রতিটি নারীকে তার সিদ্ধান্তের জন্য সম্মান জানানো উচিত।
  • বিবাহবিচ্ছেদ বা পারিবারিক সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নারী শ্রমিকদের জন্য সহজ ও বিনামূল্যে আইন সহায়তা প্রয়োজন।
  • গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থাকা জরুরি। অনেকেই নিরবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, যার সমাধান জরুরি।
  • যারা একা থেকে সন্তান লালন-পালন করছেন, কাজ করছেন—তাদের জন্য সম্মানজনক সামাজিক স্বীকৃতি গড়ে তোলা দরকার।

শেষ কথা

সাইলেন্ট ডিভোর্স কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক বাস্তবতা, যা আমাদের সমাজের কাঠামো এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

রোকসানা ইয়াছমিন শিমুল

সেন্টার কো -অর্ডিনেটর

বড়বাড়ি-গাজীপুর

Updated: May 28, 2025 — 5:37 pm
”শ্রমিক বান্ধব ব্লগ” © 2018