”শ্রমিক বান্ধব ব্লগ”

Bangladesh Center for Workers’ Solidarity

অসহায় শ্রমিকের শ্রমঅধিকার আদায়ের গল্প

গাইবান্ধা  জেলার এক অজপাড়া গাঁয়ের ২২ বছর বয়সী সাহসী তরুন  রাসেল। ৪ ভাই -বোনদের মধ্যে  রাসেল  বড় ছেলে । মা, বাবা আর দাদি সহ ৮ জনের সংসার । ভূমিহীন  রাসেল  এর বাবা পরের  কৃষি  জমিতে কাজ করে কোন রকমে  সংসার চালায়। বাবার অমানষিক পরিশ্রম  সহ্য করতে না পেরে পড়াশোনা  ছেড়ে  বাবার সাথে  কৃষি কাজ শুরু করে। দুইজনের এত পরিশ্রমেও  সংসারের অভাব  পুরন হচ্ছে না।

অবশেষে সংসার এর প্রয়োজন মেটাতে কাজের সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে রাসেল।

গাজীপুরে একটি গার্মেন্টস কারখানায়  কাজ নেয়। গ্রামের সরল ছেলে জীবিকার তাগিদে মন দিয়ে কাজ করে।  কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, গামেন্টস এ  খালি গালি গালাজ, খারাপ ব্যবহার,  আর এতো খাটুনীর পর বেতন অনিয়মিত। সহকর্মীরা সবাই বলে এই অত্যাচার সহ্য করেই নিরুপায় হয়ে  কাজ করতে হবে কিছু বললেই চাকরি চলে যাবে।

তারুন্যদ্বীপ্ত রাসেলের প্রতিবাদী চেতনা এই অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সবসময় কিছু করে শ্রমিকদের শোষনের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা ছিল।  পরিচিত এক শ্রমিকের কাছ থেকে বিসিডব্লিউএস এর খোজ পায়। বিসিডব্লিউএস এর ভাইবোনদের কাছ থেকে রাসেল শ্রমআইন, শ্রমিকদের অধিকার এর উপর সচেতন  বিষয়ক প্রশিক্ষন নেয়। সে প্রশিক্ষনের পর বুঝতে পারে শ্রমিকের অধিকারের কথা আর কিভাবে কর্তৃপক্ষের সাথে শান্তিপূর্ন আলোচনা করে অধিকার আদায় করা যায় তাও জানতে পারলো।

রাসেল সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করে, সবাইকে নিয়ে কথা বলে কারখানার ম্যানেজম্যান্ট এর সাথে। সব শ্রমিক একত্রিত হয়ে কারখানার ম্যানেজম্যান্টকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে কারখানায় উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে আর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে শ্রমিকদের ভালো পরিবেশ দরকার,তাদের ন্যায্য পাওনা দিতে হবে। তাহলেই  শ্রমিকরা কোন আন্দোলন  করবে না। উৎপাদন ও ঠিকমতো হবে।শ্রমিকদের মন ভালো  থাকবে।

রাসেল ও তার সহকর্মীরা বিসিডব্লিউএস পরিবার কে ধন্যবাদ জানিয়েছে।

এভাবে বিসিডব্লিউএস থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে হাজারো শ্রমিক সচেতন হয়ে তাদের অধিকার আদায় করেছে, শ্রমিকদের সুন্দর কর্মপরিবেশের জন্য বৃদ্ধি পেয়েছে হাজারো কারখানার উৎপাদনশীলতা এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রাখছে অনন্য ভূমিকা।

মোঃ রাসেল

একজন গার্মেন্টস শ্রমিক

সম্পাদনা

হাবিবা

সংগঠক. বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কারস সলিডারিটি

Updated: July 14, 2021 — 10:12 pm

লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে আত্নবিশ্বাসী এখন নার্গিস

আমি নার্গিস আশুলিয়ার স্থানীয় কারখানায় অপারেটর পদে কাজ করি। গত কয়েক মাস যাবত আমার ফ্লোর ইনচার্জ আল-আমিন দুষ্টুমি করে আমাকে অনেক কথাই বলে প্রথমে আমি ভাবতাম হয়তো এমনিতেই আমার সাথে দুষ্টমি করে। কিন্তু কয়েকদিন যাবত আল- আমিন আমাকে দেখলেই বলে তোমাকে সুন্দর লাগে তুমি সবসময় সেজেগুজে থাকবা। আমার মোবাইল নাম্বার কেমনে জানি ম্যানেজ করেছে আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে উল্টা পাল্টা কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু আমি পাওা দেয়না। দুই তিনদিন আগে দুপুরের খাবার খেতে বাসায় যাওয়ার জন্য বের হওয়ার পর আল-আমিন আমাকে কল দিয়ে বলে তুমি কোথায়, আমি বললাম আমি বাসায় যাচ্ছি,  তখন বলে তুমি দাঁড়াও আমি তোমার বাসায় যাবো তখন আমি বলি আপনি আমার বাসায় কেন যাবেন এই বলে আমি ফোনের লাইন কেটে দেয় তারপর উনি আমাকে আরো কয়েকবার ফোন দেয় কিন্তু আমি রিসিভ করি নাই। লাঞ্চ করে অফিসে আসার পর আল- আমিন আমাকে দূর থেকে ফলো করে আমি ফ্লোরে আসার পর কাজে বসে মুখ থেকে মাস্কটা খুলার সাথে সাথে আমাকে চেম্বারে ডেকে নিয়ে যায় মাস্ক খুলার অপরাধে, তখন আমাকে অনেক গালি-গালাজ করে বলে তুমি ঠিকমতো কাজ করোনা,কাজে ফাঁকি দাও, কাজ রেখে বসে থাকো আরো বলে আমার কথামতো না চললে এখানে চাকরি করতে পারবানা। তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে আমার সাথে ঘুরতে যেতে হবে এসব বলে আমাকে মেশিনে পাঠিয়ে দেয়। তারপর থেকে কাজে সামান্য ভুল হলে গালি-গালাজ করে আমিতো এখন বুঝি উনি আমার সাথে কেন এমন করে আমি কোন প্রতিবাদ করতে পারিনা কারন প্রতিবাদ করলে এটা যখন জানাজানি হবে তখন সবাই আমাকেই খারাপ বলবে কারন আমি মেয়ে আমাদের সমাজে মেয়েদের দোষ বেশি। তাছাড়া আমার চাকরিটাও থাকবেনা  প্রতিবাদ করলে মান- সম্মান ও যাবে সাথে চাকরিও যাবে তাই প্রতিবাদ না করে অসহায় হয়ে চুপ করে সহ্য করে নিজেই নিরাপদে থাকার চেষ্টা করি।

একদিন আমার সহকর্মির কাছ থেকে বিসিডব্লিউএস এর কথা শুনলাম। ওর সাথে বিসিডব্লিউএস এর আশুলিয়া সেন্টার এ কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের করনীয় ILO C-190 বিষয়ের উপর প্রশিক্ষন নিলাম আর কিভাবে সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে জানলাম। সেন্টারের আপাদের কাছে আমার ইন-চার্জের অত্যাচারের কথা বললাম ওরা আমাকে সাহস দিল আর অভিযোগ লিখে দিলো এবং অ্যাডমিন কে অভিযোগ পত্রে স্বাক্ষর দিয়ে জমা দিতে বললো, যদি কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নেই তাহলে বিসিডব্লিউএস থেকে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করবে বলে আশ্বাস দিলো। আমার অভিযোগ পত্র অ্যাডমিন দেখার পর ইন-চার্জ কে ডেকে কড়া ভাষায় শাসন করলো। এরপর সে কখনো আমাকে বাজে কিছু বলার সাহস পায়নি।

বিসিডব্লিউএস থেকে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও ILO C-190 প্রশিক্ষন নিয়ে আমি অনেক আত্নবিশ্বাসী।

নার্গিস

নারী গার্মেন্টস শ্রমিক

সম্পাদনা

আকলিমা আক্তার পলি

সংগঠক, আশুলিয়া সেন্টার

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কারস সলিডারিটি

Updated: July 1, 2021 — 7:21 pm

অভাব আর স্বামীর নির্যাতনে ক্ষত বিক্ষত সালমার চোখে নতুন আশা

পেট কাটার তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে দু’তলার সিঁড়ি ভেঙে সালমা পৌছালেন বিসিডব্লিওএস এর অফিসে।কোন উপায় যে ছিলনা,লোকমুখে শুনেছেন করোনাকালীন চাকুরীচ্যুতদের কর্মমুখী প্রশিক্ষন ও ত্রান দেয়া হচ্ছে, তাই অন্যের সহায়তা নিয়ে কাটাপেটে হাত চেপে চলে আসছেন।
অল্প বয়স, শারীরিক গঠন ও ছোট- খাটো,কিন্তু চোখ মুখ যে কত কথা বলতে চাচ্ছে তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
বরিশালের মেয়ে, মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম।আর্থিক অস্বচ্ছলতা নাই।ভালোই চলছিলো, বাবার সংসারে।
কিন্তু ৫ বছর বয়সে মা কালা জ্বরে মারা যান।কোন ভাই বোন ও ছিল না।২বছর কাটার পর বাবা আবার বিয়ে করেন।
প্রথম দিকে সৎ মা ভলোই ছিল,পরে যখন ভাই – বোন হতে লাগলো, বাড়ির কাজের পাশাপাশি সব কিছুর দায়িত্বটাও বেড়ে গেল। পড়া লেখা বন্ধ হয়ে গেল।বাড়ির কাজ করেই দিন শেষ হতো,তা না হলে যে খাবার জুটবে না, মায়ের কথাই শেষ কথা।
হঠাৎ মাথায় একদিন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, সৎ মা বাড়ির রাখালের সাথে বিয়ে ঠিক করলো। কারন, বাবাও এর মাঝে অসুস্থ হয়ে বিছানা নিছে। বাবা কিছু করতে পারলেন না।

“কপালরে মাইনা নিলাম। কষ্টে গ্রাম থাইকা আইসা গাজীপুরের একটা কারখানায় চাকুরী নিলাম। এর মইধ্যে বিয়া বইলাম। সারাজীবন কত কষ্ট করছি,আর হেয় যদি আমার পাশে থাকে সমস্যা কি?
হেয় একটা হোটেলে কাম করতো, আর আমি গার্মেন্টসে। আমার টাকা দিয়া সব করতাম আর হের টাকা দিয়া যে নেশা করতো, এইডা বুঝে আসে নাই। হে কইতো টেকা জমায়। পরে নেশার টেকার লাইগা মারতো। এর মধ্যে করোনার জন্য ডিউটি বন্ধ হয়ে গেল। টেকা দিতে পারতাম না বইলা আর ও বেশি মারতো। মন ডা চাইতো হেরে ছাইড়া দিমু, পেটে বাচ্চা নিয়া আর পারলাম না।
শুরু হইলো আরেক অত্যাচার, হিসেব কইরা কই, বাচ্চা হইলে ৩-৪ বছর কাম করতে পারবি না, তাইলে বাচ্চা মাইরা ফালা। আমি কইলাম এইডা আমি পারুম না। ডেলিভারির আগে হে নিখোঁজ, খোড়াকির ভয়ে হে পালাইয়া গেলো। আমার বেদনা উঠলো, নিজের কেও নাই। বাড়িওয়ালায় চাঁদা তুইলা আমারে হাসপাতালে লই। আমার পোলাডা দেখতে অনেক সুন্দর কিন্তু আমি এখন বাচুম কেমনে। নিজের সিজারের টাকা দিমু কেমনে, খামু কি,পোলারে খাওয়ামু কি? হঠাৎ আমার মামাতো বোনের সাথে কথা হয়। ওর কোন পোলাপাইন নাই ১৩ বছর ধইরা। হেয় আইসা, ৪০ হাজার টাকা দিয়া পোলাডারে নিয়া গেছে আজ ৫ দিন। কলিজা পোড়ে কন কি করমু, পোলাদারে তো বাচন লাগবো, খালি মনেরে স্বান্তনা দেই, পোলাডা তো ভালো আছে।
তার কান্না যেন আরও বাড়লো, সেলাইয়ে টান লাগে তাও পানি ধরে রাখতে পারলো না।
“একা মানুষ খাই, আমার ২ মাস এমনেই যাইবো। আফনেগো আল্লায় ভালো করুক। অনেক অনেক দোয়া করি, আফনারা এমনিই মাইনষের উপকার কইরেন। আফা আপনেগো এইখানে আমি টেরনিং নিমু পেটের সিলাই শুকাইলে। আমি আর অত্যাচার সমু না, আমার টা আমিই দেখুম।“
বিসিডব্লিউএস থেকে শ্রম আইন ও প্রযুক্তির প্রশিক্ষন নিয়ে আলোকিত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ফিরে যায় সালমা।

শিমুল

কো অর্ডিনেটর, গাজীপুর

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কারস সলিডারিটি

Updated: June 30, 2021 — 5:34 pm
”শ্রমিক বান্ধব ব্লগ” © 2018