”শ্রমিক বান্ধব ব্লগ”

Bangladesh Center for Workers’ Solidarity

Category: নিরাপদ কর্মস্থল

লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে আত্নবিশ্বাসী এখন নার্গিস

আমি নার্গিস আশুলিয়ার স্থানীয় কারখানায় অপারেটর পদে কাজ করি। গত কয়েক মাস যাবত আমার ফ্লোর ইনচার্জ আল-আমিন দুষ্টুমি করে আমাকে অনেক কথাই বলে প্রথমে আমি ভাবতাম হয়তো এমনিতেই আমার সাথে দুষ্টমি করে। কিন্তু কয়েকদিন যাবত আল- আমিন আমাকে দেখলেই বলে তোমাকে সুন্দর লাগে তুমি সবসময় সেজেগুজে থাকবা। আমার মোবাইল নাম্বার কেমনে জানি ম্যানেজ করেছে আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে উল্টা পাল্টা কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু আমি পাওা দেয়না। দুই তিনদিন আগে দুপুরের খাবার খেতে বাসায় যাওয়ার জন্য বের হওয়ার পর আল-আমিন আমাকে কল দিয়ে বলে তুমি কোথায়, আমি বললাম আমি বাসায় যাচ্ছি,  তখন বলে তুমি দাঁড়াও আমি তোমার বাসায় যাবো তখন আমি বলি আপনি আমার বাসায় কেন যাবেন এই বলে আমি ফোনের লাইন কেটে দেয় তারপর উনি আমাকে আরো কয়েকবার ফোন দেয় কিন্তু আমি রিসিভ করি নাই। লাঞ্চ করে অফিসে আসার পর আল- আমিন আমাকে দূর থেকে ফলো করে আমি ফ্লোরে আসার পর কাজে বসে মুখ থেকে মাস্কটা খুলার সাথে সাথে আমাকে চেম্বারে ডেকে নিয়ে যায় মাস্ক খুলার অপরাধে, তখন আমাকে অনেক গালি-গালাজ করে বলে তুমি ঠিকমতো কাজ করোনা,কাজে ফাঁকি দাও, কাজ রেখে বসে থাকো আরো বলে আমার কথামতো না চললে এখানে চাকরি করতে পারবানা। তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে আমার সাথে ঘুরতে যেতে হবে এসব বলে আমাকে মেশিনে পাঠিয়ে দেয়। তারপর থেকে কাজে সামান্য ভুল হলে গালি-গালাজ করে আমিতো এখন বুঝি উনি আমার সাথে কেন এমন করে আমি কোন প্রতিবাদ করতে পারিনা কারন প্রতিবাদ করলে এটা যখন জানাজানি হবে তখন সবাই আমাকেই খারাপ বলবে কারন আমি মেয়ে আমাদের সমাজে মেয়েদের দোষ বেশি। তাছাড়া আমার চাকরিটাও থাকবেনা  প্রতিবাদ করলে মান- সম্মান ও যাবে সাথে চাকরিও যাবে তাই প্রতিবাদ না করে অসহায় হয়ে চুপ করে সহ্য করে নিজেই নিরাপদে থাকার চেষ্টা করি।

একদিন আমার সহকর্মির কাছ থেকে বিসিডব্লিউএস এর কথা শুনলাম। ওর সাথে বিসিডব্লিউএস এর আশুলিয়া সেন্টার এ কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের করনীয় ILO C-190 বিষয়ের উপর প্রশিক্ষন নিলাম আর কিভাবে সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে জানলাম। সেন্টারের আপাদের কাছে আমার ইন-চার্জের অত্যাচারের কথা বললাম ওরা আমাকে সাহস দিল আর অভিযোগ লিখে দিলো এবং অ্যাডমিন কে অভিযোগ পত্রে স্বাক্ষর দিয়ে জমা দিতে বললো, যদি কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নেই তাহলে বিসিডব্লিউএস থেকে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করবে বলে আশ্বাস দিলো। আমার অভিযোগ পত্র অ্যাডমিন দেখার পর ইন-চার্জ কে ডেকে কড়া ভাষায় শাসন করলো। এরপর সে কখনো আমাকে বাজে কিছু বলার সাহস পায়নি।

বিসিডব্লিউএস থেকে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও ILO C-190 প্রশিক্ষন নিয়ে আমি অনেক আত্নবিশ্বাসী।

নার্গিস

নারী গার্মেন্টস শ্রমিক

সম্পাদনা

আকলিমা আক্তার পলি

সংগঠক, আশুলিয়া সেন্টার

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কারস সলিডারিটি

Updated: July 1, 2021 — 7:21 pm

এ্যাকর্ড আমাদের জন্য হুমকি নয়, এ্যাকর্ড আমাদের আর্শীবাদ।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। সাভারের সেই ভবন ধসের দুর্ঘটনায় চাপা পরে প্রান হারান হাজারো শ্রমিক। দিনটির ভয়াবহতার কথা স্মরণ হলে আঁতকে উঠে সারা বিশ্ব। আর ওই দুর্ঘটনায় সারা বিশ্বের নজর এসে পরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের উপর। এই ঘটনার পর বদলে যেতে  শুরু করে বাংলাদেশের পোশাক খাতের কর্ম পরিবেশ এবং শুরু হয় পোশাক খাতের সংস্কার কাজ।

ক্রেতাদের আন্তর্জাতিক দুটি সংগঠনঃ এ্যাকর্ড ( ইউরোপের ক্রেতাদের জোট- এ্যাকর্ড অন ফায়ার এন্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ) ও এ্যালায়েন্স ( উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোট- এ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি) এবং বাংলাদেশের বুয়েটের একটি টিম নিয়ে শুরু করা হয় পোশাক খাতের সংস্কার কাজ। এই টিমটি পোশাক শিল্পের কর্ম পরিবেশের উন্নতি ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করনে ( ভবন কাঠামো, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা) ২০১৮ সাল পর্যন্ত কাজ করে ২৫৫৯ টি কারখানার সংস্কার কাজ চালিয়ে থাকে।

ইতিমধ্যে এ্যাকর্ড এবং এ্যালাইন্স এর কার্যক্রমকে মালিক ও সরকার পক্ষ হতে  বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে, বাংলাদেশে এ্যাকর্ড এবং এ্যালায়েন্স এর আর প্রয়োজন নেই বলে, ২০১৮ সালে ক্রেতাজোটের মনোনীত প্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকার, বিজিএমইএ, বুয়েট বিশেষজ্ঞদের স্বমন্বয়ে গঠন করা হয় রেমিডিয়েশন কো- অর্ডিন্রেশন সেল (আর সি সি) সংস্কার সমন্বয় সেল। যেটি স্বনির্ভর  প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি পোশাক খাতের মানউন্নয়নে এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্স এর পরিপূরক হিসেবে ১৫৪৯ টি কারখানার সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে যাত্রা শুরু করে এবং বিলুপ্তি ঘটে এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্স নামক সংগঠনের।

 আর সি সি এর উপর দেশী বিদেশী প্রতিষ্ঠান গুলো আস্থা না রাখতে পারার কারণে, দেখা দেয় পোশাক খাতে নতুন সংকট। পোশাক খাতে চলমান সংকট কাটাতে ব্র্যান্ড, ট্রেড ইউনিয়ন, বিজিএমইএ নিয়ে গঠিত হয় আরএমজি সাস্টেইনেবলটি কাউন্সিল ( আর এস সি)।

এ্যাকর্ড চলে যাবার পরেও এই কাউন্সিল পোশাক কারখানাগুলোতে পরিদর্শন, প্রতিকার, প্রশিক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

এ্যাকর্ড/এ্যালায়েন্স/ আর সি সি/ আর এস সি  যেভাবেই বলিনা কেন-

এ্যাকর্ড বাংলাদেশে আসার পর কমপ্লাইন্স সেক্টর এর মূল্য বেড়েছে, কমপ্লাইন্স এর গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। কারখানার অবকাঠামোগুলো ঠিক হয়েছে, কাজের পরিবেশ পরিবর্তনগত ছোঁয়া পেয়েছে, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জমাদি ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে, শ্রমিকেরা আইন অনুযায়ী তাদের পাওনা আদায় করে নিচ্ছে, মালিকেরা দায়বদ্ধতায় এসেছে,  শ্রমিকেরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে শ্রম আইন সম্পর্কে জানতে পারছে,   শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারার প্রয়োগ ( পিসি কমিটি, সেফটি কমিটি) শুরু হতে থাকে সেই সাথে শ্রমিকেরা নিজেদের কথা বলতে শুরু করতে পেরেছে।

কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের দেশে পোশাক শিল্প কোন দিকে যাচ্ছে- এটা ভেবে এ্যাকর্ডকে নিয়ে আমরা আলোচনা- সমালোচনা করে বিতর্ক করা এবং পোশাক শিল্প ধ্বংসের উপাধি দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু বাস্তবে কি এ্যাকর্ডের কারণে, এই শিল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে…? ফ্যাক্টরী কেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এটার দায় কার…?  সরকার নাকি এ্যাকর্ড নাকি বায়ার…?

বাস্তবতা হচ্ছে,   এটার দায় সম্পূর্ন মালিকের। কেননা বায়ার এর কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে যে পরিমান এলসি খোলার কথা, সেই পরিমান এলসি না খুলে তার থেকে তিনগুন বেশি এলসি খুলে যায় মালিক পক্ষ। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে জমি, বাড়ী,  ফ্লাট এবং বিলাসিতা করে কাটিয়ে দেয়। এর পর ব্যাংক থেকে নিজের নামে  কোটিকোটি টাকা লোন নিয়ে ফ্যাক্টরীতে ব্যয় করে। ভুয়া এলসি খুলে ব্যাংকের কাছে দেনা হয়ে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

আর কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়- মালিক পক্ষ থেকে বিবৃতি আসে, সবকিছু ঠিক থাকার পরেও এ্যাকর্ড, ব্রান্ড এবং দেশীয় শ্রমিক সংগঠনের অযোক্তিক চাহিদার কারণে তারা কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। মালিক পক্ষের এই বিবৃতি মোটেও সত্যি নয়।

এ্যাকর্ডের কার্যক্রম কি বাংলাদেশের জন্য আরও প্রয়োজন..?

বাংলাদেশে এ্যাকর্ড এর পরিবর্তে আর এস সি কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এ্যাকর্ড যেসকল কারখানায় চুক্তি করা বায়ারদের কাজ চলমান রয়েছে, সেসকল কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কারণ, বায়ারদেরও এখানে দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বায়াররা এ্যাকর্ডের চুক্তির মেয়াদ বর্ধিত না করলে, বায়ারদের এই দায়বদ্ধতা থাকবে না। এক্ষেত্রে আমাদের আবার শুরু করতে হবে শূন্য থেকে। শ্রমিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব যেমন কারখানার মালিক এবং সরকারের ঠিক তেমনি বায়াদেরও রয়েছে।

মোটকথা- এ্যাকর্ড আমাদের জন্য হুমকি নয়, এ্যাকর্ড আমাদের আর্শীবাদ।

 

নওশাদ রায়হান

বিসিডাব্লিউএস- কোনাবাড়ী।

Updated: May 24, 2021 — 11:35 am
”শ্রমিক বান্ধব ব্লগ” © 2018