”শ্রমিক বান্ধব ব্লগ”

Bangladesh Center for Workers’ Solidarity

Category: অন্যান্য

অভাব আর স্বামীর নির্যাতনে ক্ষত বিক্ষত সালমার চোখে নতুন আশা

পেট কাটার তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে দু’তলার সিঁড়ি ভেঙে সালমা পৌছালেন বিসিডব্লিওএস এর অফিসে।কোন উপায় যে ছিলনা,লোকমুখে শুনেছেন করোনাকালীন চাকুরীচ্যুতদের কর্মমুখী প্রশিক্ষন ও ত্রান দেয়া হচ্ছে, তাই অন্যের সহায়তা নিয়ে কাটাপেটে হাত চেপে চলে আসছেন।
অল্প বয়স, শারীরিক গঠন ও ছোট- খাটো,কিন্তু চোখ মুখ যে কত কথা বলতে চাচ্ছে তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
বরিশালের মেয়ে, মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম।আর্থিক অস্বচ্ছলতা নাই।ভালোই চলছিলো, বাবার সংসারে।
কিন্তু ৫ বছর বয়সে মা কালা জ্বরে মারা যান।কোন ভাই বোন ও ছিল না।২বছর কাটার পর বাবা আবার বিয়ে করেন।
প্রথম দিকে সৎ মা ভলোই ছিল,পরে যখন ভাই – বোন হতে লাগলো, বাড়ির কাজের পাশাপাশি সব কিছুর দায়িত্বটাও বেড়ে গেল। পড়া লেখা বন্ধ হয়ে গেল।বাড়ির কাজ করেই দিন শেষ হতো,তা না হলে যে খাবার জুটবে না, মায়ের কথাই শেষ কথা।
হঠাৎ মাথায় একদিন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, সৎ মা বাড়ির রাখালের সাথে বিয়ে ঠিক করলো। কারন, বাবাও এর মাঝে অসুস্থ হয়ে বিছানা নিছে। বাবা কিছু করতে পারলেন না।

“কপালরে মাইনা নিলাম। কষ্টে গ্রাম থাইকা আইসা গাজীপুরের একটা কারখানায় চাকুরী নিলাম। এর মইধ্যে বিয়া বইলাম। সারাজীবন কত কষ্ট করছি,আর হেয় যদি আমার পাশে থাকে সমস্যা কি?
হেয় একটা হোটেলে কাম করতো, আর আমি গার্মেন্টসে। আমার টাকা দিয়া সব করতাম আর হের টাকা দিয়া যে নেশা করতো, এইডা বুঝে আসে নাই। হে কইতো টেকা জমায়। পরে নেশার টেকার লাইগা মারতো। এর মধ্যে করোনার জন্য ডিউটি বন্ধ হয়ে গেল। টেকা দিতে পারতাম না বইলা আর ও বেশি মারতো। মন ডা চাইতো হেরে ছাইড়া দিমু, পেটে বাচ্চা নিয়া আর পারলাম না।
শুরু হইলো আরেক অত্যাচার, হিসেব কইরা কই, বাচ্চা হইলে ৩-৪ বছর কাম করতে পারবি না, তাইলে বাচ্চা মাইরা ফালা। আমি কইলাম এইডা আমি পারুম না। ডেলিভারির আগে হে নিখোঁজ, খোড়াকির ভয়ে হে পালাইয়া গেলো। আমার বেদনা উঠলো, নিজের কেও নাই। বাড়িওয়ালায় চাঁদা তুইলা আমারে হাসপাতালে লই। আমার পোলাডা দেখতে অনেক সুন্দর কিন্তু আমি এখন বাচুম কেমনে। নিজের সিজারের টাকা দিমু কেমনে, খামু কি,পোলারে খাওয়ামু কি? হঠাৎ আমার মামাতো বোনের সাথে কথা হয়। ওর কোন পোলাপাইন নাই ১৩ বছর ধইরা। হেয় আইসা, ৪০ হাজার টাকা দিয়া পোলাডারে নিয়া গেছে আজ ৫ দিন। কলিজা পোড়ে কন কি করমু, পোলাদারে তো বাচন লাগবো, খালি মনেরে স্বান্তনা দেই, পোলাডা তো ভালো আছে।
তার কান্না যেন আরও বাড়লো, সেলাইয়ে টান লাগে তাও পানি ধরে রাখতে পারলো না।
“একা মানুষ খাই, আমার ২ মাস এমনেই যাইবো। আফনেগো আল্লায় ভালো করুক। অনেক অনেক দোয়া করি, আফনারা এমনিই মাইনষের উপকার কইরেন। আফা আপনেগো এইখানে আমি টেরনিং নিমু পেটের সিলাই শুকাইলে। আমি আর অত্যাচার সমু না, আমার টা আমিই দেখুম।“
বিসিডব্লিউএস থেকে শ্রম আইন ও প্রযুক্তির প্রশিক্ষন নিয়ে আলোকিত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ফিরে যায় সালমা।

শিমুল

কো অর্ডিনেটর, গাজীপুর

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কারস সলিডারিটি

Updated: June 30, 2021 — 5:34 pm

তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার করে জুয়া খেলে নিঃস্ব হচ্ছে তরুন শ্রমজীবি মানুষ

বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের জনগন তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সমাজের সকল স্তররের পেশাজীবিরা এখন অ্যান্ড্রয়েড চালিত স্মার্ট ফোন ব্যবহার করছেন। একই সঙ্গে প্রযুক্তির অপব্যবহার করে যুক্ত হচ্ছেন আনলাইন জুয়া খেলায়। কোনাবাড়ী অঞ্চলের প্রায় ৮০% ছাত্র- তরুন- যুবকেরা অনলাইনে জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে রয়েছে।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের আমরা অবহেলিত, অসচেতন এবং পিছিয়ে পরা  জনগোষ্ঠী ভাবলেও তারাও এখন স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধীরে ধীরে অনলাইনে জুয়া খেলার দিকে আসক্ত হয়ে পরছে।

অনেকটা আগ্রহের সাথে, বন্ধুদের চাপাচাপি, লোভ এবং অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন গেমস খেলার অভিজ্ঞতা থেকেই প্রযুক্তির অপব্যবহার করে, কোনাবাড়ী অঞ্চলের প্রায় ৩০% শ্রমিক অনলাইনে জুয়া খেলার সাথে যুক্ত রয়েছেন।

এটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে, সারা মাস বাজি খেলে মাস শেষে বেতন পেয়ে একেবারে বাজির টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছেন। এর ফলে যা হচ্ছেঃ

— পরিবারে অশান্তি

— সম্পত্তি বিক্রি

— টাকার জন্য ফ্লোরে মারামারি

— উপার্জন নষ্ট করা

— সম্পর্ক নষ্ট

— মানসিক অশান্তি

— ঋনগ্রস্থ হয়ে পরা।

— কাজে অমনোযোগী হওয়া।

আশিকুর রহমান– তিনি কোনাবাড়ী অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে।  ১৮ বছর বয়স থেকেই তিনি গার্মেন্টসে কাজ করা শুরু করেন। গার্মেন্টসে দীর্ঘ ০৪ বছর কাজ করে ২লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমিয়েছিলেন। কাজ করার পাশাপাশি, খেলাধুলার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহী ছিলেন তিনি। মাঠে খেলতে গিয়েই তিনি প্রথমে ঠান্ডা পানীয় দিয়ে বাজি খেলতেন এরপর ৫০০ টাকা করে ম্যাচ বাজি খেলতেন। এভাবেই বাজি খেলা শুরু হয়। একদিন তিনি তার বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারেন, টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচের উপরও বাজি ধরা যায়। একা বাজি ধরার সাহস না পেলে অনেকজন একসাথে মিলেও বাজি ধরা যায়। প্রথম প্রথম আশিকুর রহমান অনেক লাভবান হয়েছিল- লাভের টাকা দিয়ে ভালো একটা মোবাইল ফোন কিনেছিলেন। এরপর তিনি বন্ধুদের মাধ্যমে খবর পান, মোবাইলে বিভিন্ন এ্যাপ্স এর মাধ্যমে এই খেলার উপর বাজি ধরা যায়। এরপর থেকেই তিনি এমন পর্যায়ে চলে যান- কারখানায় কাজের সময়ও মোবাইল ব্যবহার করতে হতো যারকারনে, তার চাকুরী চলে যায়। চাকুরী চলে যাবার পর তিনি দীর্ঘ ০৩ বছর ধরে এই জুয়া খেলার সাথে যুক্ত রয়েছেন। জুয়া খেলার সাথে যুক্ত হয়ে তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা নষ্ট করেছেন, বর্তমানে তিনি ১.৫ লক্ষ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে ঘুরছেন।

ভুক্তভোগীরা কাছ থেকে জানতে পেরেছি- তারা প্রথমে মাঠ পর্যায়ে এ্যাজেন্টের মাধ্যমে বাজি ধরলেও এখন বেট থ্রি সিক্সটি ফাইভ, বেট ভিক্টর, নেটবেট, ডাফাবেট, উইকেট বেটা লাইভ ক্রিকেট ইত্যাদি বিভিন্ন এ্যাপ্স এর মাধ্যমে বাজি ধরছেন।

বাজি ধরা হচ্ছে- আইপিএল, বিপিএল, বিগব্যাশ, কাউন্ট্রি ক্রিকেট, এশিয়া কাপ, ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা গুলোর বল, রান, উইকেট, ম্যাচ নিয়ে।

ধরা যাক- মুম্বাই এবং চেন্নাইয়ের খেলা হচ্ছে। কেউ মুম্বাইয়ের জন্য ১০০০ টাকা বাজি ধরলেন। জিতলে সে পাবে ১৮০০ টাকা। অনুরূপ ভাবে চেন্নাইয়ের হয়ে কেউ বাজি ধরে জিতলে সে পাবে ২০০০ টাকা।

এ্যাপ্স এর মাধ্যমে বিভিন্ন সাইট গুলোতে বাজি ধরার টাকা বিকাশ, রকেট, নগদ এর মাধ্যমে লেনদেন করা হয়ে থাকে। সময়ে সময়ে এসব সাইট বন্ধ হয়ে গেলেও ভিপিএন, প্রক্সি সার্ভারের মাধ্যমে  বিকল্প পন্থায় তা আবার ব্যাবহার করা যায়।

সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এসব অবৈধ সাইট গুলোর বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলায় তাদের সাইট/ এ্যাজেন্ট অফিস রয়েছে। এসব অফিস থেকে  সার্ভার পরিচালনা, লিংক দেওয়া, লেনদেন করা এমনকি টাকা না পেলে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করার মত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

বাংলাদেশের আইনে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করা আছে কিন্তু অনলাইনে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ নিয়ে কোন নীতিমালা না থাকায় খুব সহজে, নীরবে, গোপনে, নিরাপদে, বাড়িতে বসে অনলাইনে জুয়া খেলা যাচ্ছে। যারা জুয়া খেলায় আসক্ত তারা বিপিএন- প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করার কারনে তাদের পুলিশ সহজে খুঁজে পায় না। তাই এসব সমস্যার সমাধান হিসেবে – সচেতনতা, অভিভাবকদের কঠোর হওয়া, জুয়া খেলার কুফল তুলে ধরা, কাউন্সেলিং করা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বৃদ্ধি করা, পূর্নাঙ্গ আইন তৈরী করা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে উন্নত প্রযুক্তি ব্যাবহারে পারদর্শী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

নওশাদ রাইহান

সেন্টার কো-অর্ডিনেটর, কোনাবাড়ী ব্রাঞ্চ

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কারস সলিডারিটি

Updated: June 30, 2021 — 11:59 am

শুন্য অনুভুতি নিয়ে জয়তুনের লড়াই

মনটা আজ তার ভীষণ খারাপ,চোখ- মুখ ফোলা।রাত ৩ টা পর্যন্ত নাইট ছিল।তারপরও আমাদের ফোন পেয়ে অফিসে আসছেন।

কি হইছে বলতেই গড় গড় করে কষ্ট গুলো বলতে শুরু করলেন।

 

“ আমার ২ মাস বয়সে মায়ে আরেক বেডার লগে ভাইগা গেছে। বাপে বিয়া করছে। আমারে দাদী পালছে, বুড়ী অনেক কষ্টে আমারে ৭ কেলাস পর্যন্ত পড়াইছে। হেরপর  ১৪ বছর বয়স হইলে বিয়াইত্তা ফোলামাইয়া আছে  এমন বেডার লগে বিয়া দিল। জামায় উঠতে বইতে নির্যাতন করে লগে খাউন পিন্দনের কষ্ট, উপায় না পাইয়া কাম নিলাম অনন্ত গার্মেন্টস এ।“, কন্ঠ যেন কেঁপে উঠলো, অশ্রুভেজা চোখে নিজের সবুজ ওড়নার দিকে তাকালো ৩৪ বছর বয়সী জইতুন।

কিছুক্ষন সময় নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আবার শুরু করলো-

“মাস না শেষ হতেই জামাই বেতনের টেকা চায়, বেডায় তাকার লেইগা পাগল হইয়া যায়, মাঝে মইধ্যে মারে, বেতন হাতে পাওনের লগে লগেই তারে টেকা দিয়া দিতাম। দাদীরেও দেওন লাগে, হে থাকে ফুফুর ঘরে। বুড়ী আমারে সোনার ডিম দেওন হাঁস মনে করে, টেকা ছাড়া কোন কতা নাই।“  -বড় একটা নিঃশ্বাস ফেললো।

“এমনেই চইলা গেলো অনেক দিন। পোলা একটা হইলো। কষ্ট কমলো না। পোলারে আরেক বাসায় রাইখা কামে যায়তাম। ঐ বেডিরেও ২০০০ টেকা দেওন লাগতো। কয়টা টেকা জমাইয়া জমি কিনলাম, জামাই রেজিস্ট্রির সময় হের নামে কইরা লইছে।“- গলা যেন ভারী হয়ে আসলো জয়তুনের, ছটফট করে আবার বলা শুরু করলো।

“আইজ ১০ মাস হইলো পোলাডারে গ্রামে লইয়া গেসে জামাই, আমি খুজ না নিলে জামাই এর কোন খবর পাওন যায় না। শর্ত  একটায়, মাসে ১০০০০ টেকা দেওন লাগবো নাইলে পোলার আশা বাদ। অহনে তো বাপে-মায়ে, জামাই, টাকা-পয়সা কিছুই নাই আমার।“

“আফা এখন আর কারও কথা মনে পড়ে না। এই চারডা হাত পাও  ছাড়া কেও আর আমার আপন না।” – অনেক চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারলনা।

“আমি শূন্য।“

জয়তুনের মনের কষ্ট চোখের পানি হয়ে বের হচ্ছে। করুন চোখে তাকিয়ে রইলো জানালার দিকে।

“আফা, আপনেগো BCWS এ কম্পুটার, শ্রম আইন টেরনিং লইয়া আরও বড় জায়গায় কাম করুম।”

জয়তুন,

নারী শ্রমিক

জইতুনের মতো হাজারো নারী শ্রমিকের কষ্টের সঙ্গী হয়ে  তাদের কল্যানে কাজ করে যাচ্ছে BCWS।

সম্পাদনা

শিমুল

গাজিপুর সেন্টার

বিসিডব্লিউএস

Updated: June 29, 2021 — 11:46 pm
”শ্রমিক বান্ধব ব্লগ” © 2018